//চট্টগ্রামের হামলা মামলায় বিপত্তি ; বাদীই জানেন না কিছুই
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারের এক গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের নামে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বিষয়বস্তু হলো চট্টগ্রামে সম্প্রতি সংঘটিত একটি ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনা। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, ফাতেমা বেগম দাবি করছেন তিনি সেই সময় চট্টগ্রামে ছিলেনই না এবং এই ঘটনার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর-শুলকবহর মাদ্রাসা সড়ক এলাকায় একটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমার ছড়া এলাকার নির্মাণ শ্রমিক সাইফুল ইসলাম আহত হন। এই ঘটনার পর ৩১ আগস্ট সাইফুলের মা ফাতেমা বেগম একটি হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করেন। তিনি ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও অনেকের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন।
চট্টগ্রামে যায়নি কিন্তু কিভাবে মামলা হলোঃ
দায়ের করা হত্যাচেষ্টার মামলার বাদী কক্সবাজারের মহেশখালীর ফাতেমা বেগম নিজে এই মামলা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত নন। ফাতেমা বেগম দাবি করেছেন, তিনি গত ২০ বছরে চট্টগ্রাম শহরে যাননি এবং এই মামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ করেনি।
উক্ত মামলায় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিম (৪৫) এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিকেকে (৩৭) প্রধান আসামি করা হয়েছে। যদিও ঘটনাটি চট্টগ্রাম শহরে ঘটেছে, তবে মামলায় কক্সবাজারের পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে প্রবীণ শিক্ষক, লবণচাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং বিএনপি নেতা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরাও রয়েছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, মামলার পর বাদীর নাম ব্যবহার করে কয়েকজন আসামির কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।
মামলার এজাহারে কি আছেঃ
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর-শুলকবহর মাদ্রাসা সড়ক এলাকায় একটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আসামিরা দলবদ্ধ হয়ে ছাত্রদের উপর নির্মমভাবে হামলা চালায়। এই হামলায় ফাতেমা বেগমের ছেলে সাইফুল ইসলাম গুরুতর আহত হয়। সাইফুলের শরীরে বহু জখমের চিহ্ন ছিল, তার মাথা ফেটে যায় এবং হাত-পা ভেঙে যায়। আহত অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মামলায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাইফুল দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তবে পরবর্তী তদন্তে জানা যায় যে, সাইফুল মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, মামলার এজাহারে ফাতেমা বেগমের স্বাক্ষর থাকলেও, তিনি নিজেকে নিরক্ষর বলে দাবি করেছেন।
চট্টগ্রাম যায়নি ফাতেমা যদিও মামলার বাদী তিনিঃ
কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাংবাদিকদের সামনে ফাতেমা বেগম অভিযোগ করেছেন যে, তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন না এবং তার নামে যে হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। গত ২৩ অক্টোবর, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের আঁধারঘোনা গ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে সাংবাদিকরা তার সাথে কথা বলেছেন।
মহেশখালীর নিজ বাসায় বসে ফাতেমা বেগম চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার কথা শুনে হতবাক হয়ে পড়েন। তিনি জানান, গত ২০ বছরে তিনি একবারও চট্টগ্রাম শহরে যাননি। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর পরিবারের জীবনযাত্রা খুবই কষ্টকর। স্বামী নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতে গেলেও তাদের দিন কাটে খুবই কষ্টে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তবে একমাত্র ছেলে সাইফুল কয়েক মাস ধরে ইজিবাইক চালিয়ে পরিবারের খরচ চালায়। অর্থের অভাবে সাইফুলের পড়ালেখাও বন্ধ রয়েছে।
ফাতেমা বেগম আরও জানান, ১৭ বছর আগে তাঁর শ্বশুরবাড়ি আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হাতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে তিনি বাপের বাড়ি আঁধার ঘোনায় আশ্রয় নেন। মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি একটি ছোট ঘরে তিনি পরিবারসহ বসবাস করেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি কোনো মামলায় জড়িত হওয়ার কথা ভাবতেও পারেননি।
ফাতেমা বেগম জানান, তার ছেলে সাইফুল গত ১০ জুলাই চট্টগ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়েছিল। ১৬ জুলাই বিকেলে ফেরার পথে মুরাদপুর এলাকায় ছাত্রলীগ, পুলিশ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়। স্থানীয়রা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তিন দিনের চিকিৎসা শেষে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে সাইফুল আর চট্টগ্রাম যায়নি এবং ফাতেমা নিজেও গত ২০ বছরে চট্টগ্রামে যাননি। সাইফুলও তার মায়ের দাবির সমর্থন করে বলে, তাদের পরিবারের কাছে পাঁচলাইশ থানায় গিয়ে মামলা করার সামর্থ্য নেই। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কে বা কারা তার মায়ের নাম ব্যবহার করে এই মামলা করেছে।
নিরক্ষর হয়েও মামলায় সাক্ষরঃ
এই ঘটনায় আরও একটি বিস্ময়কর দিক হলো, মামলার এজাহারে ফাতেমা বেগমের স্বাক্ষর থাকলেও তিনি নিজেকে নিরক্ষর বলে দাবি করেছেন। ফাতেমার প্রতিবেশীরাও এই দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, ফাতেমা বেগম সই করতে জানেন না। এমনকি, যদি ফাতেমা বাদী হয়ে মামলা করতেন, তাহলে তারা তা জানতেন। কিন্তু মামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তাদের সাথে যোগাযোগ করেনি। এই বিষয়টি মামলার রহস্য আরও ঘনীভূত করে তুলেছে।
পূর্বশত্রুতার জেরে আসামিঃ
এই মামলায় আসামি করা হয়েছে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নুর হোসেন সিকদারকে। তিনি দীর্ঘদিন বান্দরবানের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তবে তিনি দাবি করেন, তিনি এই ঘটনার সাথে কোনোভাবেই জড়িত নন। তার মতে, পুরনো কোনো শত্রুতা বা বিরোধের কারণে তার নাম এই মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পেকুয়া থানার এএসআই মো. সামছুদ্দীন ভূঁইয়া যখন তদন্তের জন্য তার বাড়িতে যায়, তখন তিনি এই বিষয়টি জানতে পারেন।
তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি গত ছয়-সাত মাসে চট্টগ্রামে যাননি এবং মামলার বাদীকেও চেনেন না। অদ্ভুতভাবে, কিছুদিন আগে একজন অজ্ঞাত নারী তাঁকে ফোন করে বাদীর নাম উল্লেখ করে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছেন। এমনকি তিনি একটি বিকাশ নম্বরও দিয়েছেন এবং টাকা না দিলে কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন। সিকদার মনে করেন, পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে তার ভাইদের সাথে বিরোধের কারণে তারা তাকে ফাঁসাতে এই ষড়যন্ত্র করেছে।
মামলার আরেকজন আসামি, কুতুবদিয়ার উত্তর কৈয়ারবিলের তমিজ উদ্দিনে ছেলে কৈয়ারবিল ইউনিয়ন বিএনপির অর্থ সম্পাদক সেলিম উদ্দিন (৩৫), এই মামলাকে একটি ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তিনি বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী এবং এর আগে তিনি চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছিলেন। তিনি সন্দেহ করেন যে, তার বিরুদ্ধে করা এই মামলা তার আগের মামলার প্রতিশোধ। কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি শফিউল আলম ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান সেলিম উদ্দিনকে একজন নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মামলায় ফাতেমা বেগমের নাম জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ মডেল থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় থানায় ব্যাপক অস্থিরতা ছিল। অনেকেই তখন তড়িঘড়ি মামলা করেছিলেন। তদন্তের জন্য পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় অনেক মামলাই তদন্ত না করেই রেকর্ড করা হয়েছিল। বর্তমানে এই সব মামলার তদন্ত চলছে। তিনি আরও জানান, যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে এজাহারে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির নাম ভুলবশতঃ জড়িয়ে গেছে, তাহলে তাকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া হবে।