রাজশাহীর একই আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ-সদস্য। ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার, আবুল কালাম আজাদ ২০২৪-এর জানুয়ারির নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হয়েছিলেন ৮ মাসের জন্য। দুজনায় একই নৌকার মাঝি হলেও মাঠের রাজনীতিতে পরস্পরের মধ্যে ছিল দা-কুড়ালের সম্পর্ক। পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অকল্পনীয় দুর্নাম করেছেন সভা-সমাবেশে। একজন আরেকজনকে নিজ নিজ এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন অনেকবার। একই দল করলেও সাবেক এ দুই সংসদ-সদস্যের অনুসারীরা পরস্পরের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বহুবার । করেছেন মামলা-মোকদ্দমা ও বাহিনী নিয়ে লড়াইয়ের খেলা ।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের আলোচিত এ দুই সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ও আবুল কালাম আজাদ বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে জীবন যাপন করছে । দুজনে থাকছেন মেলবন্ধনের সারথী হয়ে একই কক্ষে। দুজন দুজনার সুখ-দুঃখের সঙ্গী ও সহযোগী হয়ে উঠেছেন তারা। এক খাবার দুজনে ভাগ করে খাচ্ছেন। একসঙ্গে নামাজ পড়ছেন। একজন আরেকজনকে ওজুর পানি তুলে দিচ্ছেন। দুই সাবেক সংসদ-সদস্যের সৌহার্দভাব এখন রাজশাহী কারাগারের সাধারণ বন্দি-কয়েদিদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসভবন থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের তিনবারের সাবেক সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক।
২৩ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হককে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। প্রথমে সাবেক সংসদ-সদস্য এনামুলকে কারাগারের একটি সেলে রাখা হয়েছিল। তবে ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কারাগারের ভেতরে অন্য বন্দিদের মারাত্মক হামলার শিকার হন তিনি। এতে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন এনামুল। ওই রাতে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর আদালতের নির্দেশে ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হককে কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার অভিযোগে বাগমারা থানায় এনামুলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪টি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
অপরদিকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। এ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক স্বতন্ত্র হয়ে কালামের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। নির্বাচনের সময় কালামের সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনীর হাতে এনামুলের শতাধিক নেতাকর্মী হামলার শিকার হন। নির্বাচনি সহিংসতার পর পক্ষে-বিপেক্ষ একাধিক মামলা হয় থানায়। কালামের ক্যাডারদের দাপটে এনামুলক নির্বাচনের পর এলাকা ছাড়েন।
অন্যদিকে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবুল কালাম আজাদ আত্মগোপন করেন। ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে কালামের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা হয়েছে। ২ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে কালামকে গ্রেফতার করে রাজশাহী জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ৪ অক্টোবর তাকে রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয়। আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন বাঁশ দিয়ে কালামের মাথায় আঘাত করেন। তবে মাথায় হেলমেট থাকায় তিনি রক্ষা পান। কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে তাকেও।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সূত্র থেকে এখন বন্ধুত্বের আলিঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি কক্ষে ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, আবুল কালাম আজাদ ও রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য রায়হানুল হককে রাখা হয়েছে। কারাগারের একটি পুরোনো কক্ষে ডিভিশনপ্রাপ্ত এ তিনজনকে রাখা হয়েছে তিনটি চৌকি পেতে। ছোট কক্ষটিতে পাশাপাশি দুটি চৌকিতে থাকছেন ইঞ্জিনিয়ার এনামুল ও আবুল কালাম আজাদ। ডিভিশনপ্রাপ্ত হাজতিদের জন্য প্রদেয় সুযোগ-সুবিধার আওতায় তারা পছন্দের খাবার অর্ডার দিয়ে খেতে পারেন। সপ্তাহে চারদিন ১০ মিনিট করে ফোনে কথা বলতে পারেন স্বজনদের সঙ্গে। দুই সপ্তাহে একবার স্বজনরা দেখা করার সুযোগ পান।জামিনে মুক্তি হয়ে আসা একাধিক বন্দি তাদের এ সকল ফুসরত আলোচনার ও মহামিলনের আলোচনায় জেলখানা এখন সমালোচনার ঝড় বইছে।