তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের জীবন খুবই সাধারণভাবে শুরু হলেও বর্তমানে তিনি এমন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, যিনি আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের শাসনামলের পর অন্য যে কোনো নেতার চেয়ে দেশটিকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছেন। পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে বর্তমানে তিনি আলোচিত এক রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন।
এরদোগানের জন্ম ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একজন উপকূল-রক্ষীর সন্তান তিনি। বেড়ে উঠেছেন তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর সমুদ্র উপকূলে। তার বয়স যখন ১৩, তার বাবা সন্তানদের আরও ভালো লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন নিয়ে ইস্তানবুলে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিশোর এরদোয়ান বাড়তি কিছু অর্থ রোজগারের জন্য রাস্তায় লেবুর শরবত ও রুটি বিক্রি করতেন।
ইসলামিক স্কুলে লেখাপড়া করেছেন তিনি। পরে ইস্তানবুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন পেশাদার ফুটবলারও ছিলেন তিনি।
এরদোয়ান জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতায় আসেন ২০০৩ সালে। সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ১১ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তুরস্কে একসময় প্রেসিডেন্টের পদটি আলঙ্কারিক হলেও এখন তিনিই সর্বসময় ক্ষমতার অধিকারী। ফলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা এখন কঠিন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনেক সমর্থক তাকে ‘সুলতান’ নামে ভূষিত করেছেন, যা অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে ব্যবহার করা হতো।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় অফিসগুলোতে নারীদের হিজাব পরার ওপর কয়েক দশক ধরে যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল, সেটি ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ নতুন এই আইনের বাইরে ছিল।
এ ছাড়া এরদোয়ান ব্যভিচারকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, চালু করার চেষ্টা করেন ‘অ্যালকোহলমুক্ত এলাকা’। সমালোচকরা বলছেন, এসবই এরদোয়ানের ইসলামপন্থী আকাঙ্ক্ষাকে প্রমাণ করে।
২০০৩ সালের মার্চ মাসে যখন এরদোয়ান তুরস্কের নেতা নির্বাচিত হন, সেসময় এক ডলারে পাওয়া যেত ১ দশমিক ৬ লিরা। কিন্তু এখন এক ডলারের মূল্য আট লিরারও বেশি।
তার শাসনামলের শুরুর দিকে দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল, হয়েছিল ব্যাপক উন্নয়নও। সাম্প্রতিককালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বহির্বিশ্বে তার শক্তি প্রদর্শনের জন্য খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, যা অনেক দেশকে ক্ষুব্ধ করেছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোতে তুরস্কের মিত্র দেশগুলোও তুর্কি প্রেসিডেন্টের এই তৎপরতায় ক্ষুব্ধ। লিবিয়া ও সিরিয়ার সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সামরিক বাহিনী। ককেশাস অঞ্চলে নাগোরনো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তাতেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক।
দুটো দেশের মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হওয়ার আগে তুরস্ক ও আজারবাইজান মিলে চালিয়েছে যৌথ মহড়া। যুদ্ধে আজারবাইজানকে সরাসরি সমর্থন দিয়ে অনেক দেশের সমালোচনার শিকার হয়েছে তুরস্ক।
আজারবাইজানিরা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিকভাবে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ। এ ছাড়া তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিকে তেল রফতানির জন্য নির্ভর করতে হয় তুরস্কের ওপর। তাদের তেলের পাইপলাইন গেছে তুরস্কের ভেতর দিয়ে। কিন্তু রাশিয়া কয়েক শতাব্দী ধরে এই ককেশাস অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
লিবিয়া ও সিরিয়া এবং সবশেষ ককেশাসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ও সেই লক্ষ্যে সামরিক তৎপরতার কারণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও তার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সম্প্রতি গ্যাসের যে বিশাল ভাণ্ডারের খোঁজ পাওয়া গেছে, সেটিও উঠে এসেছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডায়। সাইপ্রাসের সমুদ্র উপকূলে গ্যাসের সন্ধানে তুরস্কের তৎপরতায় সাইপ্রাস ও গ্রিসের সরকার ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এই দুটো দেশই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য। এ বিষয়ে ইইউও প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে সতর্ক করে দিয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ অবজ্ঞা করে এরদোয়ান উত্তর সাইপ্রাসে তুর্কি জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বঘোষিত সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তুরস্কই একমাত্র দেশ যারা এই স্বীকৃতি দিল।
সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সে ইসলামপন্থীদের দমনে তৎপর হলে এবং ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফরাসি প্রেসিডেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা বলেছেন। ফরাসি পণ্য বয়কটেরও ডাক দিয়েছেন তিনি। এতে ফ্রান্স ক্ষুব্ধ হয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, বহু আগে থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বেশ কিছু ইসলামপন্থী এজেন্ডা রয়েছে। মিসরে নিষিদ্ধ-ঘোষিত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে রয়েছে তার আদর্শগত মিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের মতো তিনিও চার আঙুল তুলে স্যালুট দেয়ার জন্য পরিচিত। এভাবে শুভেচ্ছা জানানোকে বলা হয় ‘রাবা’।
এ বছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইস্তানবুলের ঐতিহাসিক একটি ভবন আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। এতে বহু খ্রিস্টান ও পশ্চিমা দেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে। দেড় হাজার বছর আগে এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল গির্জা হিসেবে। অটোমান টার্কের আমলে এটিকে মসজিদে পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু পরে কামাল আতাতুর্ক ভবনটিকে জাদুঘরে পরিণত করেন, যা ধর্মনিরপেক্ষ নতুন তুরস্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
এই সাইটের সব ধরণের সংবাদ, আলোকচিত্র, অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্ট কপিরাইট আইন দ্বারা সুরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই কন্টেন্ট ব্যবহারের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আইনত শাস্তিযোগ্য। আমরা আমাদের ব্যবহারকারীদের একটি সুরক্ষিত ও তথ্যবহুল অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমাদের নিউজ সাইটের মাধ্যমে পাওয়া যেকোনো তথ্য ব্যবহারের আগে দয়া করে সেই তথ্যের উৎস যাচাই করতে ভুলবেন না। আপনাদের সমর্থন এবং সহযোগিতা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। আমাদের সাথেই থাকুন, সর্বশেষ খবর এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে।

 
                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
 
                                     
                                     
                                     
                                                                             
                                     
                                