সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা ও নীতিমালা প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ এবং বৈশ্বিক পর্যটকদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি যেমন অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তেমনি প্রকৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে, সমুদ্র সৈকত এবং সমুদ্রসংলগ্ন এলাকাগুলো পর্যটকদের অসচেতন আচরণের ফলে দূষণের শিকার হচ্ছে। কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটার মতো জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোতে এই সমস্যাটি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের দূষণ শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেই বিঘ্নিত করছে না, বরং জীববৈচিত্র্যকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পর্যটকদের সমুদ্র দূষণ থেকে বিরত রাখা এখন সময়ের দাবি, এবং এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ।
পর্যটকদের অসচেতনতা এবং দূষণের কারণ
পর্যটকদের অনেকেই প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন নন। তারা আনন্দ উপভোগ করতে গিয়ে সমুদ্র এবং এর আশপাশের পরিবেশকে দূষিত করে ফেলেন। বিশেষ করে, প্লাস্টিক পণ্য, পানীয় বোতল, খাবারের প্যাকেট, এবং সিগারেটের অবশিষ্টাংশ যত্রতত্র ফেলার প্রবণতা লক্ষণীয়। এই সব বর্জ্য সাগরে গিয়ে সরাসরি পানি দূষিত করে এবং জলজ প্রাণীর জীবন বিপন্ন করে তোলে। সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্য চক্রে প্রবেশ করে, যা পরে মানুষের জন্যও স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
এর পেছনে মূলত দুটি কারণ কাজ করে। প্রথমত, অনেক পর্যটকই জানেন না যে তাদের আচরণ পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়ত, কিছু পর্যটক জেনেশুনেও অসচেতনভাবে আচরণ করেন, কারণ তাদের মনে হয় তাদের একক কাজ পরিবেশের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বাস্তবে, অনেক পর্যটকের সম্মিলিত অসচেতনতা একটি বৃহৎ সমস্যার জন্ম দেয়।
পর্যটকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা
পর্যটকদের সমুদ্র দূষণ থেকে বিরত রাখতে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল সচেতনতা বৃদ্ধি করা। পর্যটন স্থানগুলোতে সচেতনতামূলক পোস্টার, বিজ্ঞাপন এবং প্রচারণা চালানো যেতে পারে, যা পর্যটকদের পরিবেশগত দায়িত্বশীলতার বিষয়টি মনে করিয়ে দেবে। “নো প্লাস্টিক” ক্যাম্পেইন বা “বর্জ্য সংগ্রহের সময়সূচি” নির্ধারণ করে পর্যটকদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব আচরণের প্রচার পর্যটকদের মাঝে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং তারা ধীরে ধীরে এই বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করবেন।
এছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পর্যটন সংস্থাগুলো মিলে একটি দীর্ঘমেয়াদী সচেতনতা কর্মসূচি তৈরি করতে পারে, যেখানে পর্যটকরা প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি আরও গভীরভাবে শিখতে পারবেন। এই ধরনের কার্যক্রম শুধু পরিবেশ সংরক্ষণেই সাহায্য করবে না, বরং পর্যটকদের আরও দায়িত্বশীল পর্যটক হতে উৎসাহিত করবে।
আইন প্রয়োগ ও কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন
পর্যটকদের দূষণ প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি কঠোর আইন প্রয়োগ করাও জরুরি। অনেক সময় শুধুমাত্র সচেতনতা পর্যাপ্ত হয় না, বিশেষ করে যখন কিছু পর্যটক ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ম ভঙ্গ করেন। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে পর্যটন এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পর্যটন এলাকায় নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য ফেলার ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং যারা নিয়ম লঙ্ঘন করবে, তাদের জন্য আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কিছু দেশে যেমন ইতালি, থাইল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্র দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। সেই মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশেও সমুদ্র দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যারা সাগরের কাছাকাছি বা সৈকতে বর্জ্য ফেলে, তাদের জরিমানা করার নিয়ম প্রণয়ন করা যেতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ পর্যটকদের মধ্যে ভয় তৈরি করবে এবং তাদেরকে দায়িত্বশীল আচরণে বাধ্য করবে।
প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ ও বিকল্প পণ্যের প্রচলন
প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্র দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই, পর্যটন এলাকাগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্য নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প পণ্য যেমন কাগজ বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহার উৎসাহিত করা উচিত। এর পাশাপাশি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও উন্নতি আনা যেতে পারে, যাতে পর্যটকরা তাদের বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলতে পারেন এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া, পর্যটন স্থাপনাগুলোতে পর্যাপ্ত ডাস্টবিন এবং বর্জ্য আলাদা করার সুবিধা থাকতে হবে। সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট স্থান এবং সেই অনুযায়ী নির্দেশনা টানানো থাকতে হবে। এতে করে পর্যটকরা সহজেই তাদের বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলে দিতে পারবেন।
স্থানীয় গাইডদের মাধ্যমে পর্যটকদের শিক্ষাদান
স্থানীয় গাইডদের একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে পর্যটকদের সমুদ্র দূষণ থেকে বিরত রাখতে। গাইডরা তাদের ট্যুরের সময় পর্যটকদেরকে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেন, যেমন কোথায় বর্জ্য ফেলতে হবে, কোন কোন কাজ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে ইত্যাদি। স্থানীয় গাইডদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে পর্যটন শিল্পে তাদের ভূমিকা আরও গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে।
সমাপনী কথা
পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকার বা প্রশাসনের নয়, বরং প্রতিটি ব্যক্তির। পর্যটকদের সমুদ্র দূষণ থেকে বিরত রাখার জন্য তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, আইন প্রয়োগ এবং প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক। আমাদের সমুদ্র সম্পদ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে সবাইকে মিলেই কাজ করতে হবে। কারণ প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা না গেলে, তা শুধু পরিবেশের ওপরেই প্রভাব ফেলবে না, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
শিক্ষানবিশ কিশোর প্রতিনিধি
দৈনিক কালের প্রতিচ্ছবি