ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনপ্রিয় খাদ্য দ্রব্য ‘নাপ্পি’।বিভিন্ন খাবারের সাথে আচারের মত এই নাপ্পি খেয়ে থাকে আদিবাসী রাখাইন সহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা। তরকারিতে স্বাদ বাড়াতে নাপ্পির ব্যবহার করে থাকে তারা।
এক সময় এই নাপ্পি ঘরে বসে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা তৈরি করে নিজেদের চাহিদা পুরণ করতো। এখন সেই নাপ্পি বানিজ্যিকভাবে বাজারজাত হয়ে আসছে। তবে এর তৈরি প্রক্রিয়া ভিন্ন। প্রতিবছর শীত মৌসুমে পটুয়াখালী সহ সমুদ্র উপকূলের শুটকি পল্লীতে চলে ‘নাপ্পি’ প্রক্রিয়াজাত করণ।
পটুয়াখালীর সমুদ্র উপকুল জুড়ে বানিজ্যিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে নাপ্পি। এ নাপ্পি তৈরীতে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্য সম্মত পদ্ধতি। একদিকে যেমন মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, অপরদিকে খালি পা ও নোংরা জুতা ব্যবহার করা হচ্ছে খাদ্য দ্রব্যে তৈরীতে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরী নাপ্পি প্রক্রিয়াজাত করণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে এমনটাই জানিয়েছেন নিরাপদ খাদ্য কতৃপক্ষ।
প্রশাসনের তদারকি না থাকায় এভাবেই নাপ্পি তৈরির প্রক্রিয়াকরণ চলছে দেদারছে। দ্রুত এসব বন্ধের দাবি জানিয়েছে স্থানীয়রা।
ছোট ভুলা চিংড়ি মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক ছোট মাছের মিশ্রণে দিয়ে তৈরি করা হয় ‘নাপ্পি’। সঙ্গে যোগ হয় কিছু বাড়তি উপাদান। শুরুতে তীব্র দূর্গন্ধ যুক্ত হলেও প্রক্রিয়া করণ শেষে তা অনেকাংশে কমে যায়। এই খাদ্য দ্রব্য যেকোনো তরকারিতে বাড়তি স্বাদের জুড়ি নেই। এসব খাবার বেশ জনপ্রিয়তার শীর্ষে পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। এছাড়াও ওই অঞ্চলের বাঙালিদের খাবারের তালিকায়ও ’নাপ্পি'র’ বেশ কদর রয়েছে।
সমুদ্রের ডুবো চর এলাকা থেকে নিষিদ্ধ বেহুন্দি জাল পেতে শিকার করা হয় ছোট ভুলা চিংড়ি মাছ। এসব ছোট ভুলা চিংড়ি মাছের সাথে নানা প্রজাতির ছোট মাছ ধরা পরে। পাইকাররা এসব মাছ খোলা ডাকের মাধ্যমে ক্রয় করেন। ইঞ্জিন চালিত ছোট নৌকা থেকে এসব মাছ এনে নির্দিষ্ট স্থানে পঁচানোর জন্য স্তুপ করা হয়। পঁচা চিড়িং মাছ প্রথমে রোদে হালকা শুকানো হয়। এরপর অপরিষ্কার খালি পায়ে বা নোংরা জুতা পড়ে পারানো হয়। পা দিয়ে পিষে আবার রোদে শুকানো হয়। রোদে শুকিয়ে রাখা ভুলা চিংড়ি মাছের সাথে লবণ এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয়। এভাবে করে ‘নাপ্পি’ প্রক্রিয়াকরণ শেষ করতে ৫-৬ দিন সময় লাগে। এসব খাদ্য দ্রব্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিদের খাবারের জন্য এসব তৈরি করা হয়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর মহিপুরের নিজামপুর, কোমরপুর, হাজীপুর, চর গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, আশাখালী সহ পটুয়াখালী ও বরগুনা সমুদ্র উপকূলের শুটকি পল্লী এলাকায় কক্সবাজার থেকে আসা ব্যবসায়ীসহ কয়েকশত মানুষ ‘নাপ্পি’ তৈরিতে কর্মব্যস্ত সময় পার করছে। তবে স্থানীয় অন্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে পদ্ধতিতে ‘নাপ্পি’ তৈরি করা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
স্থানীয়রা জানান, পঁচা চিংড়ি মাছ রোদে হালকা শুকিয়ে পা দিয়ে পিসে ‘নাপ্পি’ তৈরি করা হচ্ছে। এতে আমাদের এলাকায় তীব্র দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পরছে। এই দূর্গন্ধে এলাকায় থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এটা খেলে যেমন স্বাস্থ্য ঝুকি রয়েছে তেমনি পরিবেশও রয়েছে হুমকির মুখে।
স্থানীয় এক স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, যে পরিবেশে "নাপ্পি" তৈরি করে তা সাধারন মানুষ খেলে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয় এর মতো রোগ হবে। আর আমাদের এলাকার পরিবেশ তো নষ্ট হচ্ছেই।
"নাপ্পি" ব্যাবসায়ী কক্সবাজারের মোঃ কালাম জানান "নাপ্পি" আমাদের এলাকার একটি জনপ্রিয় খাবার, যা আমাদের এলাকার পাহাড়িরা থেকে সব লোকেরা খায়। এতে কোন স্বাস্থ্য ঝুকি নেই আমারাও এটা খাই।
চট্রগ্রামের আরেক ব্যবসায়ী আবুল কালামের সাথে কথা হলে তিনিও বলেন, ভালো মাছ প্রথমে স্তুপ করে রেখে এরপর রোদে হালকা শুকিয়ে পা দিয়ে পারানো হয়। এরপর নাপ্পি তৈরী করা হয়। এতে ৫-৬ দিন সময় লাগে। তবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে করা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এবিষয়ে কথা হয় শুটকি পল্লী এলাকার কমরপুরের বাসিন্দা ও শুটকি ব্যবসায়ী মো. সাইফুলের সঙ্গে। তিনি জানান, নাপ্পি তৈরীর কারনে পুরো পল্লী এলাকায় তীব্র দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এসবের সাথে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয় যা চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি। খালি পেটে এসবের কাছে গেলে বমি চলে আসে। এসব যতোই সুস্বাদু হোকনা কেন, তৈরি করণ কেউ নিজ চোখে দেখলে আর খাবেনা।
একই অভিযোগ করেন শুটকি পল্লীর আরেক ব্যবসায়ী রাকিবসহ আরো কয়েকজন। তারা বলেন, যে পরিবেশে নাপ্পি তৈরী করণ চলছে তা আসলেই স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে করা হচ্ছে না। প্রশাসনের যাতে এসব তদারকি করেন এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। নতুবা এসব বন্ধের দাবি জানান তারা।
নাপ্পি তৈরী করণ হারভেষ্টর পদ্ধতিতে হয় বলে জানান কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা।
তিনি বলেন, সামুদ্রিক ছোট মাছ থেকে তৈরী হওয়া ‘নাপ্পি’ আদিবাসীদের একটি জনপ্রিয় খাবার। এটি অবশ্যই স্বাস্থ্য সম্মত পদ্ধতিতে করতে হবে। আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। যদি নিয়ম বহির্ভূত এসব প্রক্রিয়া করণ করা হয় তবে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিব।
এবিষয়ে পটুয়াখালী জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকতা আবু রায়হান প্রতিবেদকে জানান, মহিপুর সহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় যে ‘নাপ্পি’ তৈরি হয় তা আমার জানা নেই। আমরা নাপ্পি'র স্যাম্পল কালেলশন করে আমাদের ল্যাবে টেষ্ট করে দেখবো। যদি কোন ক্ষতিকর ক্যামিক্যাল বা ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাকের মতো জীবানু পাওয়া যায় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হয় তাহলে তা বন্ধে দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়া হবে। ###
সম্পাদক ও প্রকাশক : আল মামুন, নির্বাহী সম্পাদক : ফোরকানুল হক (সাকিব), ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : সোহাগ আরেফীন,
প্রধান কার্যালয় : ৯২, আরামবাগ ক্লাব মার্কেট, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত