এই মুহুর্তে সরকারের বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি রোধ। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর গুলোতে এখনো বসে আছেন বহু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
সওজের রাঘব বোয়ালেরা অধিকাংশই গণভবনের নাম ব্যবহার করতেন। এখন ভোল পালটিয়েছেন দুর্নীতিবাজরা। তাদের সাথে কথা বললে মনে হয় যেন, তারাই আওয়ামীলীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন।
ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজরা তাদের স্বভাব পরিবর্তন করতে না পারলেও রাতারাতি ভোল পালটিয়েছেন। স্ব-স্ব চেয়ারে আছেন বহাল তবিয়তে। চিহ্নিত এসব দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রয়েছে পাহাড় সমপরিমাণ অভিযোগ। তারপরও তাদের টনক নড়েনি। এখন আবার নতুন করে লেবাস বদলের প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। তাদেরই একজন সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে শেখ পরিবারের প্রতি নতজানু ছিলেন সড়ক ও জনপদ অধিদফতরের ময়মনসিংহ সার্কেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী। তিনি ঘুষ-দুর্নীতিতে ছিলেন বেপরোয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব তহবিলে শওকত আলী মাসিক টাকা পাঠাতেন। যা ছিলো ওপেন সিক্রেট। গণভবনে শওকত আলীর ছিলোঅবাধ বিচরণ। এই অসাধু ব্যক্তি শুধু গণভবনকে ব্যবহার করে সওজে বিস্তার করেছেন একক আধিপত্য। তার অবৈধ টাকা উপার্জনের সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার ছিলো গণভবন। নিজ এলাকাতেও তার এই প্রভাব বিস্তারের কথা বলে বেড়াতেন। শওকত আলীর প্রভাব এবং ক্ষমতার দাপট সেই আগের মতোই রয়েগেছে। গ্যাংস্টার হিসেবে খ্যাত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বেশির ভাগ সম্পদ করেছেন বড়ো ভাই যুবায়দুল ইসলামের নামে। বড়ো ভাই যুবায়দুল ইসলামের পুরবী ট্রেডার্স নামে বরিশালে একটি মিক্সার প্লান্ট আছে। এই প্রতিষ্ঠানকে সামনে রেখে যতসব ধান্দাবাজি করেন শওকত আলী। বড়ো ভাই যুবায়দুল ইসলামের আয়ের উৎস কি তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন বিজ্ঞমহল। সওজ কর্তৃপক্ষও জানতে চান শওকত আলীর গোপন রহস্যের গণ্ডি কোথায়?
অনুসন্ধানে জানা যায়, জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি থানার চর বয়ড়া ধানপটিঁ বাজার গ্রামের স্কুল শিক্ষক আলহাজ্ব এম.এ সাত্তার এর ছেলে শওকত আলী। তিনি সওজে চাকরি নেয়ার পর থেকেই ছোট-খাটো ঘুষ বাণিজ্য'র সাথে জড়িয়ে পড়েন। কিভাবে এলাকায় সবচেয়ে ধনী মানুষের তালিকায় নাম লেখাবেন সে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন সব সময়। তার এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। জামালপুর জেলা সদর থেকে শুরু করে সরিষাবাড়ির প্রতিটি গ্রামের মানুষের কাছে প্রথম শ্রেণীর ধনী মানুষ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু কিভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হলেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী তা অনেক টাই অজানা। তবে গোবরে পদ্ম ফুলের মতো ঘটেছে শওকত আলীর জীবন কাহিনী। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য হচ্ছে। তিনি সওজে চাকরি করেই শিল্পপতি হয়েছেন। তবে এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে ঘুষের টাকায়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি বেসামাল হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজম এবং একজন প্রতিমন্ত্রীর হাত ধরে একের পর এক পদোন্নতি পান শওকত আলী। সৌভাগ্যবান এই ব্যক্তি দু'হাতে ঘুষ বাণিজ্য করে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। এজন্য তিনি সব সময় সামলিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা ও প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থদের। নিজের জন্য করেননি এমন কিছু তার বাকি নেই। মুখে যথেষ্ট মজাদার এই কর্মকর্তার ম্যানেজিং পাওয়ার দুর্দান্ত। ভবিষ্যতে এমপি হবার জন্য এলাকায় সমাজ সেবামূলক কিছু কাজের সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছেন। আওয়ামীলীগের ছত্রছায়ায় নিজের এবং পরিবারের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন শওকত আলী।
গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর শওকত সিন্ডিকেট কিছুটা নিশ্চুপ মেরে ছিলেন। কিন্তু এক মাসের মাথায় আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। নিজের ধন-সম্পদ এবং ক্যারিয়ার ধরে রাখতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিএনপি নেতাদের বাসা-বাড়িতে। কোটি কোটি টাকার বাজেট নিয়েই বিএনপিতে ভিড়তে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সফল হলে চাকরী থেকে অবসর নিয়ে আগামী নির্বাচনে বিএনপির পতাকায় জাতীয় সংসদে প্রার্থী হবেন শওকত আলী। এমনটাই গুঞ্জন শোনা গেছে শওকত আলীর এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, ব্রীজ, কালভার্ড, ঘুপচি টেন্ডার, ঘুপচি বিল ভাউচার, আউট সোর্সিং জনবল নিয়োগ, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য এবং বড়ো সব টেন্ডার বাণিজ্য'র মূল হোতা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী। এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে তিনি কমিশন বাণিজ্য বা ঘুষ বাণিজ্য করেননি। তার মনোনীত ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়া ও বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন । তিনি ঘুপচি টেন্ডার ও ঘুপচি বিল ভাউচারে অনেক পারদর্শী।
একই অভিযোগ সওজ এর প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে নির্বাহী প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে। তারা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং শত শত কোটি টাকা আত্নসাত করেও বহাল তবিয়তে আছেন। অন্তবর্তী সরকার শওকত সিন্ডিকেটের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। শুধু মাত্র বিভিন্ন ডিভিশনে চলছে বদলী ও পদোন্নতি।
অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী নিজের নামে, বউয়ের নামে, শাশুড়ীর নামে এবং ভাইদের নামে শত কোটি টাকার সম্পদ, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এবং ব্যাংক ব্যালেন্স করেছেন। ঢাকার আফতাব নগরের ডি ব্লকে ১১ নাম্বারে দশ তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়িতে রাজকীয় জীবন-যাপন করছেন সপরিবারে । তাছাড়া আফতাবনগরের ১ নম্বর এল ব্লকের ০৩/০৫ রোডে ৫ কাঠার একটি প্লট, এল ব্লকের ১ নাম্বার রোডের ২৭ নাম্বার প্লটে ৭ কাঠার উপর বাড়ি, এইচ ব্লকের ২ নম্বর মাদ্রাসা রোডে ১০ কাঠার ১০ কাঠার একটি প্লট, এন ব্লকে দশ কাঠার আরেকটি প্লট, এম ব্লকে ৭ কাঠার আরো একটি প্লট রয়েছে শওকত আলীর। সরিষা বাড়িতে বাবার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তিন বিঘা জমির উপরে এম এ সাত্তার আইডিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়িও। ঢাকার আশিয়ান সিটিতে বিশ কোটি টাকা মুল্যের বিশ কাঠার প্লটও রয়েছে শওকত আলীর। উক্ত প্লটে অবকাঠামো নির্মাণ করে একটি ছাত্রাবাস স্থাপন করেছেন ।
ময়মনসিংহ শহরেও করেছেন আলীশান বাড়ি। অবৈধভাবে অর্জিত টাকার বড়ো একটি অংশ বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে শওকত আলীর বিরুদ্ধে। কথায় কথায় মানুষকে গোয়েন্দা সংস্থায় তার বন্ধুরা চাকরি করে বলে গল্প দিয়ে থাকেন। আবার অনেককে তাদের বরাত দিয়ে ভয়-ভীতিও দেখান।
অনুসন্ধানে আরো বেরিয়ে আসে যে, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ময়মনসিংহ বিভাগে নিম্নোক্ত ঠিকাদারের সাথে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক রয়েছে শওকত আলীর। যেমন- টাংগাইল ভুয়াপুর তারাকান্দি রোডে ১৮০ কোটি টাকার কাজে সমপরিমান অংশীদার জনি এবং যুবায়দুল ইসলামের। টাঙ্গাইল ভুয়াপুর তারাকান্দি রোডে আরেকটি কাজে সুমন ও যুবায়দুল ইসলামের অংশীদারত্বও সমপরিমান। এছাড়া টাঙ্গাইল, গোপালপুরে আজিজ, মাসুদ, মনোজ এবং যুবায়দুল ইসলামের পার্টনারশীপ ঠিকাদারি রয়েছে। এই সিন্ডিকেট অত্র এলাকায় ঠিকাদারি ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পদে ছিলেন। ঘাটাইলের পাকুল্লায় ফুট ওভার ব্রীজের কাজ দেয়া হয়েছে ম্যাস এন্টারপ্রাইজকে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মিঠুর সাথে ঠিকাদারি ব্যবসা আছে যুবায়দুলের। প্রতিটি কাজে শওকত আলী তার বড়ো ভাই যুবায়ইদুল ইসলামের নামে ৫০% (পঞ্চাশ পারসেন্ট) ভাগ নিয়ে ঠিকাদারকে কাজ দিয়ে থাকেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগে প্রকাশ, উক্ত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনস্থ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীগণ ঠিকাদারি সিন্ডিকেট এর অধীনে কোন মাল না কিনেই বিল উত্তোলন, ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে প্রত্যেকেই অবৈধ সম্পদ ও শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করেন দেশের বাইরে। নিজেরা মনোরঞ্জন করতে মাঝেমধ্যেই চলে যান বিভিন্ন দেশে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন তারা। সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট থেকে কমিশন বাণিজ্য হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের অবৈধ আয়ের মূল উৎস। আর এর নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলী।
অভিজ্ঞমহলের মতে, আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব ( আমলা) থেকে শুরু করে দপ্তর-অধিদপ্তরের চেয়ারম্যান, ডিজি, প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং নির্বাহী প্রকৌশলী সহ পিয়ন পর্যন্ত সিন্ডিকেট করে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। সেক্টর কর্পোরেশন গুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির আখড়া গড়ে উঠার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের উপর।
অভিযোগের সত্যতা জানতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শওকত আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : আল মামুন, নির্বাহী সম্পাদক : ফোরকানুল হক (সাকিব), ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : সোহাগ আরেফীন,
প্রধান কার্যালয় : ৯২, আরামবাগ ক্লাব মার্কেট, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত