//ক্ষতিপূরণে ঘুষ, মাছ ধরায় বাধা, বেড়িবাঁধ নষ্ট; গণশুনানিতে ক্ষোভ ঝাড়লেন ভুক্তভোগীরা
//জাল পুড়িয়ে প্রতিবাদ জেলে পরিবারের
আপনারা কি চান আমরা ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যাই? - স্থানীয় বাসিন্দা
কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ওরিয়ন গ্রুপের প্রস্তাবিত ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের জোরালো দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিশিষ্টজনরা।
আজ শনিবার (১০ই মে) মাতারবাড়ি কে জি বিদ্যালয়ে আয়োজিত এক গণশুনানিতে এ দাবি জানান তারা।
প্রায় চার শতাধিক স্থানীয় বাসিন্দার (কৃষক, জেলে, চিংড়ি ও লবণচাষী) উপস্থিতিতে এ গণশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) এবং উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন)। সহ-আয়োজক হিসেবে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা), জেট-নেট বিডি, প্রতিবেশ ও উন্নয়ন ফোরাম (এফইডি), মহেশখালী জনসুরক্ষা মঞ্চ এবং সংশপ্তক।
গণশুনানিতে প্রধান বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জনাব খালিদ মিসবাহুজ্জামান। এছাড়াও সহ-বিচারক হিশবে উপস্থিত ছিলেন জনাব রাবেয়া সুলতানা, এডভোকেট, জেলা দায়রা জজ আদালত, সাংবাদিক মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন, মোঃ নুরন্নবী, প্রধান শিক্ষক, মাতারবাড়ি মডেল কেজি স্কুল এবং জনাব মোঃ আলাউদ্দিন, ইউপি সদস্য, মাতারবাড়ি ইউনিয়ন।
উক্ত গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় বাসিন্দারা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তাদের অভিজ্ঞতা, উদ্বেগ ও দুর্দশা প্রকাশ করেন। তাদের দাবি, প্রস্তাবিত ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে মাতারবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এতে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষ করে মৎস্যজীবী, লবণচাষী, কৃষক ও দিনমজুর শ্রেণির পরিবারগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ছিন্নভিন্ন জীবিকা আর বিষাক্ত পরিবেশের অভিযোগ
গণশুনানিতে অংশ নিয়ে স্থানীয়রা মাতারবাড়িতে বিদ্যমান কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাবের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেন। তাদের অভিযোগ, পরিবেশের ওপর এই প্রকল্পের ধ্বংসাত্মক প্রভাব তাদের জীবন ও জীবিকাকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
মোস্তাফা নামে এক নারী ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, কয়লা পোড়ানোর ফলে বাতাসে ছড়ানো বিষাক্ত ছাইয়ের কারণে তাদের ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, "আমার ছোট বোনের লাউ গাছে এখন আর লাউ ধরে না। লাউয়ের ক্ষেত আবহাওয়া দূষণে এমনভাবে দূষিত হয়েছে যে ছাইয়ের আস্তরণ জমে যায়, ফসল হয় না। শুধু লাউ নয়, অন্য ফসলেরও একই অবস্থা।"
মেজবাহ উদ্দিন আরেক স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে মাতারবাড়ির ঐতিহ্যবাহী লবণ চাষ, পান চাষ, কৃষি ও মাছ চাষ – সব ধরনের জীবিকাই হুমকির মুখে পড়েছে। একদিকে কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন স্থানীয়রা, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণে জীবনই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এসব ক্ষতিকর কয়লা প্রকল্প থেকে সরে এসে বায়ু বিদ্যুৎ বা সৌর বিদ্যুতের মতো পরিবেশবান্ধব বিকল্প জ্বালানির দিকে সরকারের মনোযোগ দেওয়া উচিত, যা দেশ ও জনগণের জন্য লাভজনক হবে।
তাদের অভিযোগ, প্রকল্পের প্রাথমিকস্তরে ইতোমধ্যে মাতারবাড়ি এলাকায় ২২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এতে বহু পরিবার আদি ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এছাড়া সুপেয় জলের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ দূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন এলাকাবাসী। তাঁরা বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে এলাকা ছেড়ে চলে যাবার উপক্রম হয়েছে।
লবণ চাষীরা তাদের দুর্দশা বর্ণনা করে বলেন, কয়লা প্রকল্পের কারণে জমির স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, লবণ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও পরিবেশ মিলছে না। ফলে আয়-রোজগার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তারা বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঐতিহ্যবাহী লবণ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হবে।
উল্লেখ্য, বিতর্কিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় ২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সরকার ওরিয়ন গ্রুপকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ৬৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ওরিয়ন পাওয়ার ইউনিট-২ ঢাকা লিমিটেডের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষরিত হয়।
পিপিএ অনুসারে, চুক্তি পরবর্তী ৪৫ মাস বা ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা। কিন্তু ওরিয়ন গ্রুপ নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন তো দূরের কথা, নির্মাণ কাজই শুরু করতে না পারায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিডিবি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মাতারবাড়ি এলাকায় সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়। পাশাপাশি ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে।
দফায় দফায় সময় পরিবর্তন করে অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আবারও মেয়াদ বাড়িয়ে ২০৩০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এই ‘এক্সটেনশন’টা না দিলে- চুক্তিটি আপনা আপনিই বাতিল হয়ে যেতে পারত। বিডব্লিউজিইডির সমর্থনে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মাসে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, জ্বালানি উপদেষ্টা ও পরিবেশ উপদেষ্টার নিকট এ দাবি করা হয়।
সরকারি তিন ব্যাংক যৌথভাবে ওরিয়ন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ১০,৫৭৯ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কোনো ক্রমেই ২০২৬ সালের মধ্যে নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। এর পরে নির্মাণ করলে ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলে গণশুনানীতে মন্তব্য করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
গত ১লা মার্চ ২০২৫, স্থানীয়বাসিন্দারা ওরিয়ন ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল চেয়ে মাতারবাড়িতে মানববন্ধন করেন। জানা যায়, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ইআইএ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে, গত ৩০ অক্টোবর ২০২৪, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে মাননীয় পরিবেশ উপদেষ্টার নিকট বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) ইআইএ বাতিলের আবেদন করে।
গত ৪ঠা মে ২০২৫, প্রস্তাবিত ওরিয়ন ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংবলিত একটি গণআবেদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবর পেশ করা হয়েছে। আবেদনটির অনুলিপি বিদ্যুৎ ও পরিবেশ সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাবৃন্দ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে।
একই তারিখে, পরিবেশ, জলবায়ু, জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি)-র উদ্যেগে ওরিয়নের কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বাতিলের জোর দাবি জানিয়ে দেশের ১৪৪টি নাগরিক সংগঠন অর্থ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সিপিজিসিবিএল-এর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর পৃথক চারটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছে।
এ সকল প্রতিবাদের জের ধরে, গত ৬ই মে ২০২৫, বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) এবং উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন) এর আয়োজনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)-তে ওরিয়ন ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয়দের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে, গণশুনানির শেষে বিচারকগণ স্থানীয়দের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে মাতারবাড়িতে ৬৩৫ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের রায় দেন। তাঁরা বলেন, এই ধরনের জীবাশ্ন জ্বালানিভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে স্থানীয় জনগণের মতামত ও পরিবেশগত প্রভাবকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। মানবকূল, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক স্বার্থসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় ওরিয়নের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের জন্য সরকারের হাতে এখনও যথেষ্ট সময় ও সুযোগ রয়েছে বলে।
উন্নয়নের নামে পরিবেশ ও মানুষের জীবিকা যেন ভুলুণ্ঠিত না হয়, সেই দাবিই জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগীরা। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলে মেগা প্রকল্পের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্পাদক ও প্রকাশক : আল মামুন, নির্বাহী সম্পাদক : ফোরকানুল হক (সাকিব), ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : সোহাগ আরেফীন,
প্রধান কার্যালয় : ৯২, আরামবাগ ক্লাব মার্কেট, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত